শেখ মামুনুর রশীদ মামুনঃ
এই দেশে এখনও কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা নিজেদের হাতকে বিশ্বাস করেন—কাঁধে ব্যাগ না নিয়ে হাতে রেঞ্চ, মাথায় চাকরির ভাবনা নয় বরং উদ্ভাবনের নকশা। এমনই এক ব্যতিক্রমী গল্প আজকে তুলে ধরা হলো—ময়মনসিংহের এক নিভৃত গ্যারেজ থেকে উঠে আসা স্বপ্নবাজ উদ্ভাবক, আবুল কালাম আজাদকে নিয়ে।
মাটির ঘ্রাণ আর ঘামের গন্ধে গড়া এই মানুষটির জীবনে নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি। নেই বিদেশি প্রশিক্ষণ কিংবা নামি কোনো প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট। তবে যা আছে, তা হলো—একরোখা জেদ, অন্তহীন অধ্যবসায়, আর দেশকে কিছু দেওয়ার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। শুরুটা ছোট, গন্তব্য বড়! ১৯৮০ সালের ১ নভেম্বর জন্ম আবুল কালাম আজাদের। বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ শহরের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। শৈশবেই যন্ত্রপাতির প্রতি তৈরি হয় গভীর মুগ্ধতা। মাত্র দশ বছর বয়সেই লেদ মেশিনে হাতেখড়ি—স্রেফ কৌতূহল থেকে যন্ত্র খুলে-গুছিয়ে দেখা, পরে তা পেশায় রূপ নেয়। শুরু হয় জীবনের প্রকৃত পাঠশালা—গ্যারেজের ভেতরে। প্রথম আবিষ্কার: প্রতিভার প্রথম প্রহর। ১৯৯৬ সালে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে তৈরি করেন অটো বাইকের চার্জার। ওই বছরই আবিষ্কার করেন নিজস্ব কাঠামোতে তৈরি যানবাহন 'নসিমন'। স্থানীয় বাজারে এটি রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে উদ্ভাবন করেন যানবাহনের জন্য শক্তিশালী লোহার হ্যাঙ্গার, যা আজও স্থানীয় ওয়ার্কশপগুলোর জন্য নির্ভরতার প্রতীক।
২০০০ সালে প্রথম তৈরি করেন কাপড় পরিস্কারের রোলার ব্রাশ এবং ২০০৯ সালে উদ্ভাবন করেন ‘ক্লাস্টিক পাম্প’। এই পাম্প এখন দেশের বিভিন্ন গার্মেন্ট কারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব আবিষ্কারে রয়েছে বাস্তব সমস্যা সমাধানের ছাপ, প্রতিটি যন্ত্র যেন একেকটি জীবন ঘনিষ্ঠ চিন্তার বহিঃ প্রকাশ। আজকের বিস্ময়: সম্পূর্ণ দেশীয় হাইড্রলিক পাম্প সর্বশেষ সংযোজন—ভারী যানবাহনের জন্য তৈরি হাইড্রলিক পাম্প। সম্পূর্ণ দেশীয় যন্ত্রাংশে নির্মিত এই পাম্প দেশের পরিবহন শিল্পে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। এর শক্তিশালী লিফটিং ও মোশন কন্ট্রোল ক্ষমতা বিদেশি বিকল্পের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। এতে যেমন কমবে আমদানি নির্ভরতা, তেমনি বাড়বে দেশীয় প্রযুক্তির প্রতি আস্থা।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও উদ্ভাবনে নেই ঘাটতি! আবুল কালাম আজাদ কখনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি। তার নেই কোনো একাডেমিক ডিগ্রি। কিন্তু তার হাতে তৈরি প্রতিটি যন্ত্রাংশ যেন একেকটি সফল প্রকৌশল গবেষণার উদাহরণ। নিখুঁত নকশা, বাস্তবমুখী কাঠামো এবং ক্ষেত্র বিশেষে আন্তর্জাতিক মানের কর্মদক্ষতা—সবই আছে তার কাজে। তিনি বলেন, “ডিগ্রি থাকলে ভালো, না থাকলেও স্বপ্ন দেখতে তো কেউ মানা করেনি। আমি চাই চায়না প্রোডাক্টের চেয়েও ভালো কিছু বানাতে, যা আমার দেশের মানুষের জন্য টেকসই এবং সাশ্রয়ী। যুবকদের জন্য বার্তা: নিজের হাতকে বিশ্বাস করো।
আবুল কালামের জীবন শুধু উদ্ভাবনের নয়, অনুপ্রেরণারও এক মহাকাব্য। হাজারো তরুণ যেখানে চাকরির জন্য হন্যে, সেখানে তিনি বলছেন—“চাকরি ভালো, কিন্তু নিজের ভেতরের শক্তিকে চিনতে হবে। নিজের হাতে গড়ো এমন কিছু, যা শুধু তোমারই নয়, দেশেরও গর্ব হয়ে দাঁড়াবে। সমাপ্তি নয়-শুরু,আবুল কালাম আজাদ কেবল একজন সফল উদ্ভাবক নন, তিনি এক চলমান অনুপ্রেরণা। যেখান থেকে তিনি শুরু করেছিলেন, সেখানে আলো কম ছিল। কিন্তু আজ তিনি নিজেই একটি আলো হয়ে উঠেছেন, যা অন্যদের পথ দেখায়। তার জীবন গল্প প্রমাণ করে—যন্ত্র শুধু মেশিন নয়, যদি সেগুলোর পেছনে থাকে এক মননশীল মস্তিষ্ক আর একটি দেশের জন্য কিছু করে দেখানোর হৃদয়। এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত আবুল কালাম আজাদ তাঁর নিজস্ব উদ্যোগে আরও দুটি নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন, যেগুলো ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে পরিবর্তন আনতে পারে।