-শেখ মামুনুর রশীদ মামুন:
-ময়মনসিংহের কেওয়াটখালীতে নির্মাণাধীন আর্চ স্টিল সেতু প্রকল্প ঘিরে উত্থাপিত হয়েছে একের পর এক গুরুতর অভিযোগ। নকশা পরিবর্তন, ভূমি অধিগ্রহণে চরম অনিয়ম, ক্ষতিপূরণ বণ্টনে পক্ষপাতিত্ব এবং প্রভাবশালী আবাসন ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে প্রকল্পের দিক বদলের অভিযোগে ফুঁসে উঠেছে স্থানীয় জনগণ। সর্বসাধারণের স্বপ্নের এই অবকাঠামো প্রকল্পটি এখন স্থানীয় দুর্নীতি ও ক্ষমতার দাপটের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।
নকশা বদলে প্রভাবশালী হাউজিং প্রকল্পকে সুবিধা-মূল নকশা অনুযায়ী সেতুর সংযোগ সড়কটি শম্ভুগঞ্জ তিন রাস্তার মোড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও, রহস্যজনকভাবে তা পরিবর্তন করে নেওয়া হয়েছে টোল প্লাজা সংলগ্ন চায়না মোড় হয়ে মুটকিভাঙ্গা ব্রিজ পর্যন্ত। এই অস্বাভাবিক বাঁক তৈরি করা হয়েছে এমনভাবে, যাতে সুবিধা পান ময়মনসিংহ হাউজিং ও ব্রহ্মপুত্র হাউজিং—দুই প্রভাবশালী হাউজিং কোম্পানি। সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে, বেড়েছে ব্যয়। স্থানীয়রা একে “ভূ-রাজনীতির অপরাজনীতি” বলে অভিহিত করছেন।
ভূমি অধিগ্রহণে অনিয়মের ছড়াছড়ি-
নকশা পরিবর্তনের ফলে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পড়েছে সংযোগ সড়ক, যেখানে হাজারো মানুষের বাসস্থান ছিল। এই সব এলাকার ভূমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে চলছে দুর্নীতির উৎসব। টিনের ঘরকে কারখানা দেখিয়ে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক বাড়ানো, জমির শ্রেণি জালিয়াতির মাধ্যমে বদল করে মোটা অঙ্ক আদায়—সবকিছুতেই জড়িত রয়েছে এক প্রভাবশালী চক্র।
আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ক্ষতিপূরণ!
-একাধিক জমির মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকার পরও, আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আইন মানার পরিবর্তে যারা জনগণের সেবা করার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের হাতেই যেন আইন ভঙ্গের কলঙ্ক লেগে আছে। এতে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে উঠেছে গুরুতর প্রশ্ন।
ক্ষতিপূরণ পেতে ঘুষ ও হয়রানি—দলিল নিয়েই বিভ্রাট-ক্ষতিপূরণের টাকা তুলতে গিয়ে ভুক্তভোগীরা পড়েছেন চরম হয়রানিতে। দলিলে সামান্য ভুল, এক অক্ষরের পার্থক্য দেখিয়ে ঘুষ দাবি করা হচ্ছে। কেউ কেউ জানান, তাদের কাছে বৈধ দলিল থাকলেও মাসের পর মাস ঘুরেও টাকা তুলতে পারেননি। ঘুষ না দিলে নথিপত্র ‘হারিয়ে’ যায়, অফিসার ‘মিটিং’-এ থাকেন—এ যেন চেনা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।
প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার কোটি টাকা!
-প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ছিল প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু নকশা পরিবর্তন ও অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণে তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৬ হাজার কোটি টাকার ঘরে। অর্থনীতিবিদরা একে বলছেন "নির্বিচারে ব্যয়বৃদ্ধির ক্লাসিক উদাহরণ"।
অভিযোগ আছে প্রকল্প পরিচালকদের বিরুদ্ধেও
-প্রকল্পের ভেতরে ভেতরে চলছে লুটপাটের রাজত্ব—এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার অপ্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠেছে প্রকল্প পরিচালনা সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সরাসরি দুর্নীতির প্রমাণ।
প্রতিবাদে সরব জনতা—দাবি দুর্নীতির তদন্ত ও শাস্তি-উত্তাল হয়ে উঠেছে জনমত। সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, স্মারকলিপি পেশ—চলছে একের পর এক প্রতিবাদ কর্মসূচি। জনগণের একটাই দাবি—নকশা পুনর্বিবেচনা করে প্রকৃত স্বার্থে কাজ করা হোক, দুর্নীতিবাজদের বিচারের আওতায় আনা হোক।
জনগণের প্রশ্ন: এই রাষ্ট্র কার?
কেউ প্রশ্ন তুলেছেন—সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প কি শুধুই প্রভাবশালীদের জন্য? যারা ট্যাক্স দেন, ঘাম ঝরান—তাদের জন্য কি অবকাঠামো নয়? এই অবস্থা চলতে থাকলে উন্নয়ন নয়, দেশ জর্জরিত হবে ‘উন্নয়নের নামে লুটপাটে’।
কেওয়াটখালী আর্চ স্টিল সেতু প্রকল্প ময়মনসিংহবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন হলেও, এখন সেটি যেন এক দুঃস্বপ্নের নাম। সরকার, স্থানীয় প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়িত্ব—অভিযোগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা, নিরপেক্ষ তদন্ত চালিয়ে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনা। এই প্রকল্পকে স্বচ্ছ ও জনবান্ধব করতে এখনই পদক্ষেপ না নিলে, এই উন্নয়ন বদলে যাবে অস্থিরতার আগুনে।